উপকূলজুড়ে বনজীবীদের মাঝে বিরাজ করছে বাঘ আতঙ্ক। টানা ৪ বছর বাঘের উপদ্রবের খবর পাওয়া না গেলেও চলতি বছর সুন্দরবনে বৃদ্ধি পেয়েছে বাঘের উপদ্রব, আক্রমণ ও বিচরণ। বাঘের আক্রমণে বনজীবী আহত ও নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এতে উপকূলীয় এলাকার বনজীবীদের মাঝে বাঘ আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
বন বিভাগ জানিয়েছে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। বনজীবীদের সতর্ক হয়ে কাজ করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
সাতক্ষীরার উপকূলবর্তী এলাকার বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার প্রধান উৎস সুন্দরবন ও সুন্দরবনের নদী, খালগুলো। সুন্দরবন থেকে মধু, গোলপাতা সংগ্রহ, সুন্দরবনের ভেতর ও সুন্দরবন সংলগ্ন খাল, নদী থেকে মাছ আহরণ করে চলে এসব মানুষের জীবন-জীবিকা। তবে এখন আতঙ্কে রয়েছে বৃহৎ এই জনগোষ্ঠী। চলতি মৌসুমে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে দুই বনজীবী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও একজন।
গত ১২ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে সুন্দরবনে মৌয়াল দলের সঙ্গে মধুর চাক খুঁজছিলেন রবিউল শেখ (২২)। হঠাৎ তার ওপর বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুখে থাবা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় তাকে। এরপর ঘাড়ে ও মাথায় কামড় বসিয়ে দেয়। এরপর পুনরায় মাটিতে আছাড় দিয়ে ঘাড়ের অন্য পাশে কামড় দেয়। তারপর পিঠের ওপর পা দিয়ে মাটিতে চেপে ধরে রাখে। রবিউল শুধু বলতে পেরেছিল, আব্বা আমাকে বাঘে নিয়ে গেল। এরপর বাকি সঙ্গীরা ছোটাছুটি শুরু করে। বাবা হালিম শেখ হাতের লাঠি দিয়ে বাঘের পিঠে আঘাত করতে থাকেন। তখন রবিউলকে ছেড়ে দিয়ে বনের ভেতর চলে যায় বাঘটি।
বাঘের আক্রমণের শিকার রবিউল শেখ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের ৯ নং সোরা গ্রামের বাসিন্দা। তার চোখে মুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ। বাঘের ভয় এখন আকড়ে ধরেছে রবিউলকে। বাঘের দাঁতে জখম হয়েছে ঘাড় ও মাথা। শরীরের বিভিন্ন স্থানে বাঘের নখের ক্ষত স্পষ্ট।
মৌয়াল রবিউল ইসলাম বলেন, ৩০-৪০ সেকেন্ডের মধ্যে এই ঘটনা ঘটেছে। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারিনি।
ঘটনার সময় সঙ্গে থাকা রবিউল শেখের চাচাতো ভাই জিয়াউর রহমান বলেন, সাপ, কুমির, বাঘ, বিভিন্ন রকম হিংস্র প্রাণিদের সঙ্গে লড়াই করে আমাদের মধু কাটতে হয়। ঝড় বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। জীবন নিয়ে সুন্দরবনে গেলেও জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরবো কি না সেটি নিশ্চিত বলা যায় না। তবুও যেতে হবে। কারণ এটাই আমাদের আয়ের উৎস।
গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের মৌয়াল মাহাবুর রহমান বলেন, সুন্দরবনে বাঘের উৎপাত বেড়ে গেছে। জীবনের হুমকি নিয়েও খেয়ে পরে বেঁচে থাকার তাগিদে সুন্দরবনে যেতে হয়। এখন বছরের অর্ধেক সময় সুন্দরবন বন্ধ থাকে। এতে আমাদের রোজগার কমেছে, বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের আব্দুল আজিজ বলেন, আমার চোখের সামনে ছেলে হাবিবুরকে বাঘে ধরলো। বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু বাঁচতে পারিনি। বাঘে যখন ঘাড়ে কামড়ে দেয় তখনও বেঁচে ছিল। কিন্তু কিছু সময় পর মারা যায় ছেলেটা।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ কার্যালয় থেকে জানা গেছে, শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায় প্রায় ৫০ হাজার বনজীবী রয়েছে। এসব বনজীবীরা সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ, গোলপাতা সংগ্রহ ও নদ-নদী থেকে মাছ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ১৩ মার্চ সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের পায়রাডাঙ্গা খালে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছেন শ্যামনগর উপজেলার আটুলিয়া ইউনিয়নের শতকুপুট গ্রামের আতিয়ার গাজীর ছেলে বাওয়াল আবুল কালাম গাজী (৫০)। ১৪ এপ্রিল নিহত হন মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মীরগং গ্রামের আব্দুল আজিজের ছেলে হাবিবুর রহমান (৩০)। এ ছাড়া ১২ এপ্রিল আহত হয়েছেন গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের হালিম শেখের ছেলে রবিউল শেখ (২২)।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালীনি ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান আহম্মেদ জানান, সুন্দরবন থেকে মৌয়াল ও বাওয়ালিরা ফিরে জানাচ্ছেন, বনে বাঘের বিচরণ বেড়ে গেছে। বাঘের পায়ের ছাপ স্পষ্ট দেখেননি। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের মুন্সিগঞ্জ কলবাড়ী এলাকায় চুনা নদীর পাড়ে বাঘ দেখতে পান অনেকে। বাঘটি ছোট একটি খাল পার হয়ে সেখানে কিছু সময় অবস্থান করে বনে চলে যায়। বনজীবীরা বাঘের বিচরণ ও আক্রমণের কারণে ভীত হয়ে পড়ছে।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের কর্মকর্তা আবুল হাসান বলেন, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ও উপদ্রব বেড়েছে। সম্প্রতি বাঘের আক্রমণে দুইজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে একজন মৌয়াল ও একজন বাওয়ালী, আহত হয়েছেন আরও একজন।
২০১৮ সালের বাঘ শুমারিতে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। ২০২০ সালে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৬টিতে। এখন এই সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। ২০২২ সালে বাঘ শুমারি করা হবে। তখন প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে, কতটি বাঘ সুন্দরবনে বেড়েছে। মূলত বাঘের গ্রোথ, বিচরণ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ধারণা করা হচ্ছে, বনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, গত চার বছর সুন্দরবনে মৌয়াল, জেলে, বাওয়ালীদের ওপর কোন বাঘের আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। তবে এ বছর বাঘের আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। বনজীবীদের সতর্ক হয়ে সুন্দরবনে চলাফেরা ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।